পৃথিবীতে ইসলামের ঝান্ডাকে সমুন্নত রাখতে যেকজন ব্যক্তি নিজের জীবনবাজী রেখে শত্রুর বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম প্রধান হলেন হযরত খালিদ বিন ওয়ালিদ। তিনি আনুমানিক ৫৯২ সালে মক্কায় জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা ওয়ালিদ ইবনে মুগিরা ছিলেন কুরাইশ বংশের বনু মাখজুম গোত্রের শেখ। মুসলমানদের মধ্যে সবচেয়ে সফল সেনাপতি হিসেবে এক বাক্যে সবাই খালিদ বিন ওয়ালিদকেই মেনে নেন। খালিদ বিন ওয়ালিদ হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) এর আমল থেকে শুরু করে আবু বকর সিদ্দিক ও ওমর ফারুক রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর শাসনামল পর্যন্ত ছোট বড় ১৫০টিরও বেশি যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছেন। কিন্তু মহান আল্লাহর ইচ্ছায় আর খালিদ বিন ওয়ালিদের রণকৌশল আর বীরত্বে একটি যুদ্ধেও তিনি পরাজয় বরণ করেননি। প্রতিটি যুদ্ধে তিনি দাপটের সাথে বিজয় লাভ করেছেন। যা বিশ্বের আর কোনো সেনানায়কের পক্ষেই সম্ভব হয়নি। মহাবীর খালিদের রণকৌশলের একটি বৈশিষ্ট্য ছিলো তিনি একেকটি যুদ্ধে একেক রণকৌশল অবলম্বন করতেন। প্রতিপক্ষ আন্দাজই করতে পারতেন না যে এই যুদ্ধে কি কৌশল অবলম্বন করছেন খালিদ। তাই কেবল মুসলমানরাই নয় ঐতিহাসিকভাবে স্বীকৃত মহাবীর খালিদকে বিশ্বের শক্তিধর ইহুদি রাষ্ট্রগুলোও পৃথিবী সেরা সেনাপ্রধান হিসেবে স্বীকার করেন । পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সেনাবাহিনীর ট্রেইনিংয়ে এখনো শেখানো হয় মহাবীর খালিদের রণকৌশল আর বীরত্বের সব ঘটনা। মিসরের খ্যাতনামা সাহিত্যিক ও ঐতিহাসিক আব্বাস মাহমুদ আল-আক্কাদ তার ‘আবকারিয়াতু খালিদ’ নামক গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন , ‘সামরিক নেতৃত্বের সব গুণাবলিই খালিদ বিন ওয়ালিদের মধ্যে বিদ্যমান ছিল। অসীম বাহাদুরি, অনুপম সাহসিকতা, উপস্থিত বুদ্ধি, তীক্ষ মেধা, অত্যধিক ক্ষিপ্রতা এবং শত্রুর ওপর অকল্পনীয় আঘাত হানার ব্যাপারে তিনি ছিলেন অদ্বিতীয়। এটা বলা অত্যুক্তি হবে না যে ইসলামের উত্থানের যুগে ইসলামী সাম্রাজ্য হজরত খালিদ বিন ওয়ালিদের হাতেই বিস্তৃত হয়। হজরত ওমর ফারুক রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর শাসনামলে মুসলমান ও বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের মধ্যে বিখ্যাত যে ইয়ারমুকের যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিলো তার নেতৃত্বে ছিলেন হজরত খালিদ বিন ওয়ালিদ। তাঁর অসীম সাহসিকতায় এই যুদ্ধে মুসলিমদের বিজয়ের ফলে সিরিয়ায় বাইজেন্টাইন শাসনের অবসান ঘটে। খালিদ বিন ওয়ালিদের আরেকটি উল্লেখযোগ্য যুদ্ধের নাম মুতার যুদ্ধ। এ যুদ্ধে তিনি এতটাই বীরত্ব প্রদর্শন করেছিলেন যে যুদ্ধ করতে করতে তার ৯টি তরবারিই ভেঙে গিয়েছিল। কেবল একটি ইয়ামেনি তরবারী তার কাছে অবশিষ্ট ছিলো। এ ঘটনাটি সহিহ বুখারিতে স্বয়ং খালিদ ইবনু ওয়ালিদ থেকেই বর্ণিত হয়েছে। আর এ যুদ্ধের পরই হযরত মোহাম্মদ (সা.) খালিদের বীরত্বে খুশি হয়ে সাইফুল্লাহ উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন। যার অর্থ আল্লাহর তরবারি। হযরত খালিদ বিন ওয়ালিদ মক্কা বিজয়, হুনাইনের যুদ্ধ, তায়েফ বিজয় ও তাবুক অভিযানে মহানবি হযরত মোহাম্মদ (স) এর সঙ্গী হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেছিলেন। অথচ ইসলাম গ্রহণের আগে উহুদের যুদ্ধে খালিদ বিন ওয়ালিদের রণকৌশলের কাছেই ধরাশায়ী হয়ে গিয়েছিলো মুসলিম বাহিনী। খালিদ বিন ওয়ালিদ তার জীবদ্দশায় যেসব সফল যুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছেন সেগুলোর মধ্যে মুতার যুদ্ধ, শেকলের যুদ্ধ, ওয়ালাজার যুদ্ধ, ওলাইসের যুদ্ধ, বুশরার যুদ্ধ, ফিরাজের যুদ্ধ, ইয়ারমুকের যুদ্ধ, লোহার সেতুর যুদ্ধ, হাজিরের যুদ্ধ , ফাহলের যুদ্ধ অন্যতম। হযরত আবুবকর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর ইন্তেকালের পর হযরত ওমর ফারুক রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু খলিফা নিযুক্ত হওয়ার পর হযরত খালিদ বিন ওয়ালিদকে সেনাপ্রধান পদ থেকে অব্যহতি দেন। আর এ কাজটি করেছিলেন এ জন্য যে মানুষ দিন দিন ধরে নিচ্ছিল খালিদ বিন ওয়ালিদ আছে বলেই মুসলমানদের পরাজিত করা যাচ্ছে না। কিন্তু ওমর ফারুক রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বোঝালেন খালিদ বিন ওয়ালিদ নয় যুদ্ধে জয় পরাজয় নির্ধারিত হয় আল্লাহর পক্ষ থেকে। দায়িত্ব থেকে অব্যহতি পেয়েও বেশ কিছু যুদ্ধে খালিদ বিন ওয়ালিদ সাধারণ সৈন্য হিসেবে অংশ নেন এবং ওমর ফারুকের উপর আনুগত্য বজায় রাখেন। ৬৪২ সালের কোনো একদিন মহাবীর হযরত খালিদ বিন ওয়ালিদ মৃত্যুশয্যায়। স্ত্রীকে পাশে ডেকে নিজের মৃত্যুটা শাহাদাতের মর্যাদায় না হওয়ার আক্ষেপ করছিলেন। তার জবাবে হযরত খালিদ বিন ওয়ালিদের স্ত্রী জানিয়েছিলেন হযরত মোহাম্মদ সাঃ আপনাকে আল্লাহর তরবারি হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তাহলে আল্লাহর তরবারি কি কখনো যুদ্ধের ময়দানে ভেঙ্গে পড়তে পারে? তাই আপনার নিয়তি শহিদ হওয়া নয় আপনার নিয়তি অপরাজেয় হওয়া। স্ত্রীর এ কথায় খুশি হয়ে আল্লাহর নাম জপতে জপতে সন্তুষ্টচিত্তে মৃত্যুবরণ করেন মহাবীর খালিদ বিন ওয়ালিদ। কেয়ামত অবধি মুসলমানদের হৃদয়ে অমর হয়ে থাকবেন এই মুসলিম বীর।
Leave a Reply